বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ, ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র প্রতিহত এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষার দাবিতে ‘মঞ্চ ৭১’ নামে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, নতুন প্রজন্ম ও ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এ মঞ্চ গঠিত হয়েছে। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (বীর প্রতীক) ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেডআই খান পান্না এ প্ল্যাটফর্মের সমন্বয় করছেন। 

 

 

সোমবার (৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় প্ল্যাটফর্মটির সমন্বয়কদ্বয় স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে। বিজ্ঞপ্তিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে।

 

 

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবময় এবং আত্মত্যাগের ইতিহাস। লাখো শহীদের রক্ত, মা-বোনদের সম্ভ্রম আর কোটি কোটি মানুষের মহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, একটি পতাকা নয়, একটি জাতীয় সংগীত নয়, বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন, চেতনা, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার নিরন্তর সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু আমরা নিদারুণ বেদনা, ক্ষোভ আর হতাশার সঙ্গে লক্ষ করছি, আজ মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।

 

এতে আরও বলা হয়েছে, আগস্ট অভ্যুত্থানের পর কথিত নানা ঘোষণাপত্র এবং বয়ানের মধ্যে জাতির সামনে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আদর্শ অর্জনকে হেয় করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ইতিহাস বিকৃতির মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যাখ্যানের চেষ্টায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা গভীরভাবে মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা, নতুন প্রজন্ম এবং ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিরা সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি বন্ধের লক্ষ্যে মঞ্চ ৭১-এর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

 

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ, ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র প্রতিহত এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষাসহ বিজ্ঞপ্তিতে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়। 

 

মঞ্চ ৭১-এর ৫ দফা দাবি:

 

১. অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। তাদের বলতে হবে, তারা কী মনে করে, কী করবে আর কী করবে না।

 

২. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা, ইতিহাস মুছে ফেলা, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানো, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার সঙ্গে সংযুক্ত সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবিলম্বে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা করে গ্রেফতার এবং বিচারের আওতায় আনতে হবে।

 

৩. কোনো রাজনৈতিক দলের অপরাধ ও ব্যর্থতার দায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা যাবে না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তাদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

 

৪. মুক্তিযুদ্ধের অর্জন, ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলে তথাকথিত নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা যাবে না। জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে। এসব স্থানে বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে সঠিক তথ্য সংযোজন এবং প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

 

৫. জুলাই ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বক্তব্য ও ব্যাখ্যা থাকবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিপক্ষে অসম্মানজনক কিছু থাকলে তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করা হবে।

এসব দাবি বাস্তবায়িত না হলে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যদি এসব পরামর্শ উপেক্ষা করে তথাকথিত কোনো ঘোষণার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিকৃত করা হয়, মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করা হয়, তাহলে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানী ঢাকায় মঞ্চ ৭১ ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করবে। এ আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের, কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। এটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, দেশের পক্ষে, রক্তস্নাত ইতিহাসের পক্ষে। জাতির অর্জনকে মুছে ফেলার সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত। যদি প্রয়োজন হয় ইতিহাস রক্ষা করার জন্য মঞ্চ ৭১ নতুন প্রজন্ম এবং বাংলাদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আত্মত্যাগে প্রস্তুত।

 

‘মঞ্চ ৭১’-এর এই আত্মপ্রকাশ এবং ৫ দফা দাবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একজন নেটিজেন, রহমান খান, লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্বের মূল। এর ইতিহাস বিকৃতি রোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ 

 

অপরদিকে, কেউ কেউ এই প্ল্যাটফর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সমালোচনা করেছেন। সোহেল রানা নামে একজন লিখেছেন, ‘ইতিহাস রক্ষার নামে নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করা কতটা যুক্তিযুক্ত?’ 

 

নতুন এই প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বীর প্রতীক বলেন, ‘এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। এটি ইতিহাস, স্বাধীনতা এবং শহীদের রক্তের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে যাতে খাটো না করা হয় সে লক্ষ্যে এ প্ল্যাটফর্ম কাজ করবে। সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধা, কমান্ডার, সেনাপতিদের আমরা একত্র করার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে অনেকেই সম্মত হয়েছেন।’ 

 

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক নতুন নয় উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আলী রিয়াজ বলেন, ‘এই ধরনের উদ্যোগ জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারে, তবে এটি যেন দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার না হয়ে পড়ে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।’ 

 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। এই যুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে অগাস্ট অভ্যুত্থানের পর, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক ও বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে। এই প্রেক্ষিতে ‘মঞ্চ ৭১’-এর আত্মপ্রকাশকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুজ্জীবনের একটি উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন।